মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) দুনিয়ার সেরা মানুষ ও আল্লাহর সেরা রাসূল। ‘রাসূল’ অর্থ প্রেরিত পুরুষ। আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে মানবজাতির হিদায়াতের জন্য তাঁর পক্ষ থেকে যেসব ব্যক্তিকে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন, তাঁদেরকে বলা হয় নবী বা রাসূল। নবী-রাসূলগণ দুনিয়ায় আল্লাহর বার্তাবাহক, সমাজে দ্বীন প্রচার করাই ছিল তাঁদের কাজ। ‘দ্বীন’ অর্থ জীবনব্যবস্থা। আল্লাহর বান্দার জন্য আল্লাহর দ্বীন হলো সর্বোত্তম জীবনব্যবস্থা। কিন্তু মানুষ অনেক সময় শয়তানের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে আল্লাহর দ্বীনের কথা ভুলে যায় এবং মানুষের তৈরি বিধিবিধান অনুসরণ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ যখন বিভ্রান্ত হয়, তখন তাদের হিদায়াতের জন্য আল্লাহ নতুন কোন নবী বা রাসূল পাঠান। এভাবে যুগে যুগে অনেক নবী-রাসূল দুনিয়ায় এসেছেন এবং তাঁরা তাঁদের যুগে ও সমাজে আল্লাহর দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
সর্বশেষ নবী হলেন মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা)। তিনি সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। তাঁর পর দুনিয়ায় আর কোন নবী-রাসূল আসবেন না। কিন্তু মহানবীর ওপর নাজিলকৃত আল্লাহর কিতাব মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও রাসূলের জীবনাদর্শ কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতিকে পথ দেখাবে। অতএব, যদি এ দু’টি জিনিস আমরা সকলে মজবুতরূপে ধারণ করি, তাহলে আমরা সঠিক পথ অনুসরণ করে চলতে পারবো। অন্যথায় আমরা বিভ্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। তাই আমাদের উচিত আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ বা জীবনাদর্শ সঠিক রূপে মেনে চলা।
মহানবীর (সা) জীবনাদর্শ সবিস্তারে লিপিবদ্ধ আছে বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে। তাঁর জন্ম থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত জীবনের সকল খুঁটিনাটি বিষয় বিভিন্ন সহীহ হাদিসে উল্লিখিত আছে। এ ছাড়া আল কুরআন পাঠেও আমরা মহানবীর জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানতে পারি। কারণ মহানবী (সা) আল-কুরআনের শিক্ষা নিজের জীবনে পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করেছেন। মূলত আল কুরআন হলো মানুষের জন্য প্রদত্ত আল্লাহর বিধান। এ বিধান কিভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে, মহানবীর (সা) জীবনাদর্শে আমরা তা প্রত্যক্ষ করি।
মহানবী (সা) দুনিয়ার সেরা মানুষ। তাঁর চরিত্র ছিল সর্বোত্তম। তিনি সকলের আদর্শ। স্বয়ং আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন : ‘তুমি অবশ্যই সর্বোত্তম চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সূরা কলম, আয়াত-৪)
৫৭০ ঈসায়িতে আরবের পবিত্র মক্কা নগরীতে মহানবীর (সা) জন্ম। তখন সে দেশের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। মানুষ তখন মূর্তিপূজা করতো, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি, ব্যভিচার-মদ্যপান, সুদ-জুয়া ও নানারূপ অন্যায়-অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকতো। মানুষে মানুষে ও গোত্রে গোত্রে সর্বদা ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকতো। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা ছিলো না, গরিব-দুঃখী, এতিম-বিধবা ও সহায়হীন লোকদের কোন নিরাপত্তা ছিলো না। এ জন্য ঐ যুগকে বলা হতো ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ বা অন্ধকার যুগ।
এ অন্ধকার যুগে জন্মগ্রহণ করেও মহানবী (সা) সমস্ত অন্যায়-অশোভন কাজ থেকে সম্পূর্ণ বিরত ছিলেন। শৈশবকাল থেকেই তাঁর চরিত্রে অসাধারণ গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য দেখে সকলে মুগ্ধ হয়। এ জন্য তাঁকে সকলে ‘আল-আমিন’ (বিশ্বস্ত) ও ‘আস-সাদিক’ (সত্যবাদী) বলে ডাকতো। তাঁর কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও কাজ-কর্মে সকলে মুগ্ধ হতো। এ জন্য ছোট-বড় সকলেই তাঁকে সমীহ করতো, ভালোবাসতো, শ্রদ্ধা করতো।
সমাজের খারাপ অবস্থা ও মানুষের দুর্দশা দেখে মহানবী (সা) ব্যথিত হন। শৈশব থেকেই তিনি এ অবস্থার পরিবর্তন সাধনের উপায় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। এ উদ্দেশ্যে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি তাঁর মতো কতিপয় কিশোর-যুবককে নিয়ে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সমাজের দুর্বল, নিরীহ, দরিদ্র, বিধবা ও অসহায় মানুষকে সাহায্য করা, অন্যায়-দুষ্কর্ম প্রতিরোধ করা এবং মানুষে মানুষে ও সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। নবুওয়ত লাভের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ তেইশ বছর তিনি এভাবে সমাজের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন।
নবুওয়ত লাভের পর তিনি মানুষের কাছে আল্লাহর দ্বীন প্রচার শুরু করেন। নবুওয়তি জিন্দেগির তেইশ বছর তিনি দ্বীন প্রচারের কাজে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত থাকেন। তিনি মদিনার সকল অধিবাসীকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সকলের সম্মতিতে ঐতিহাসিক মদিনা সনদ ঘোষণা করেন। এ সনদের ভিত্তিতেই সেখানে একটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে, যার নেতা নির্বাচিত হন স্বয়ং মহানবী (সা)। সে ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে সমগ্র আরব ভূখণ্ডে বিস্তৃত হয়। মহানবী (সা) ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। দুনিয়ায় সেটাই প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র এবং বিশ্বের সকল মুসলমানের জন্য একটি আদর্শ ও অনুসরণযোগ্য রাষ্ট্রব্যবস্থা। মহানবী (সা) সেখান থেকে সারা দুনিয়ায় ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। ফলে ক্রমান্বয়ে সমগ্র বিশ্বে ইসলাম এক বিজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মহানবী (সা) একজন মানুষ এবং আল্লাহর রাসূল। মানুষ হিসেবে তিনি সেরা রাসূল হিসেবেও শ্রেষ্ঠ। তিনি ছিলেন আদর্শ নেতা ও মানবজাতির মহান শিক্ষক। তিনি দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন এবং সে দ্বীনের আলোকে নিজের জীবন, পরিবার, সমাজ-রাষ্ট্র ইত্যাদি সব কিছু পরিচালনা করেছেন। রাষ্ট্র পরিচালক, সমরনায়ক, সমাজপতি, বিচারক, নীতি-নির্ধারক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আদর্শ ব্যক্তি। ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী, পিতা, ভাই, বন্ধু, অভিভাবক, প্রতিবেশী ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি ছিলেন সকলের আদর্শ। তাঁর মহান চরিত্র ছিলো সম্পূর্ণ নিখুঁত ও সকলের নিকট প্রশংসনীয়।
হযরত যায়েদ বিন হারিসা (রা) আজীবন মহানবীর (সা) খাদেম ছিলেন। যায়েদ ছিলেন কালব গোত্রের হারিসা বিন শুরাহবিল (অথবা শারাহবিল)-এর পুত্র। আট বছর বয়সে তিনি তাঁর মা সু’দা বিনতে সালাবাহর সাথে নানার বাড়ি বেড়াতে গেলে সেখানে বনি কায়ন বিন জাসর গোত্রের লোকজন অন্যান্যদের সাথে যায়েদকেও অপহরণ করে নিয়ে তায়েফের নিকটবর্তী ওকাজ মেলায় তাঁকে বিক্রি করে দেয়। হাকিম বিন হিশাম মেলা থেকে যায়েদকে কিনে তার ফুফী খাদিজাকে (রা) উপহারস্বরূপ প্রদান করে। মহানবীর (সা) সাথে হযরত খাদিজার বিয়ের পর যায়েদকে তিনি খাদেম হিসেবে মহানবীর খেদমতে পেশ করেন। তখন যায়েদের বয়স পনের বছর।
এদিকে যায়েদের বাপ-চাচা হারানো সন্তানকে খুঁজতে খুঁজতে মক্কা শরীফে এসে জানতে পারেন যে, যায়েদ মহানবীর নিকট আছেন। যায়েদের বাপ-চাচা মহানবীর (সা) নিকট এসে যায়েদকে ফেরত নেয়ার আবেদন জানান। তারা মহানবীকে (সা) প্রস্তাব দেন যে, তিনি যে পরিমাণ ফিদিয়া (মুক্তিপণ) চান তা তারা দিতে প্রস্তুত। ফিদিয়ার বিনিময়ে তারা যায়েদকে ফিরে পেতে চান। মহানবী (সা) এ কথা শুনে বলেন, ঠিক আছে আমি যায়েদকে তোমাদের সামনে হাজির করছি। এবং সব কিছু তাঁর মর্জির ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। সে যদি স্বেচ্ছায় তোমাদের সাথে যেতে চায়, তা হলে কোনরূপ ফিদিয়া লাগবে না, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে। আর যদি সে আমার নিকট থাকতে চায় তা হলে আমি এমন ব্যক্তি নই যে, কেউ আমার নিকট থাকতে চাইলে জরবদস্তি করে তাকে বের করে দেব।
এরপর মহানবী (সা) যায়েদকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি এ দুই ব্যক্তিকে চেন?’ যায়েদ বললেন, ‘হ্যাঁ, ইনি আমার পিতা আর উনি আমার চাচা।’ মহানবী (সা) বললেন, ‘তুমি আমাকেও চেন, তাদেরেকও চেন। এখন তুমি পূর্ণ স্বাধীন। তুমি ইচ্ছা করলে তোমার বাপ-চাচার সাথে তোমার বাড়িতে ফিরে যেতে পার অথবা আমার নিকটও থাকতে পার।’ যায়েদ বললেন, ‘আমি আপনাকে ছাড়া কারো কাছে যেতে চাই না।’ এ কথা শুনে যায়েদের বাপ-চাচা উভয়েই সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি স্বাধীনতা ছেড়ে গোলামিকে বরণ করে নিতে চাচ্ছ?’ তখন যায়েদ তাঁর পিতাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আব্বাজান! আমি এ মহান ব্যক্তির অনন্য গুণাবলি সম্পর্কে সম্যক অবগত, তাঁর সান্নিধ্যের বিনিময়ে দুনিয়ার অন্য কারো সান্নিধ্য আমার নিকট অভিপ্রেত নয়।’ এ কথা শুনে যায়েদের বাপ-চাচা উভয়ে অভিভূত হলেন এবং তাঁকে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আর পীড়াপীড়ি করলেন না। মহানবীও (সা) তৎক্ষণাৎ যায়েদকে (রা) আজাদ করে দিলেন এবং তাকে নিয়ে কা’বা শরীফে সকলের সামনে ঘোষণা দিলেন, ‘তোমরা সাক্ষী থাক, আজ থেকে যায়েদ আমার পুত্র, সে আমার ওয়ারিশ হবে এবং আমি তাঁর ওয়ারিশ হবো’। প্
রকৃতপক্ষে তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরা এসেছেন, তারা সকলেই তাঁর চরিত্র-মাহাত্ম্যে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছেন। নাঙা তলোয়ার হাতে তাঁকে খুন করতে এসেও তাঁর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তলোয়ার ফেলে দিয়ে কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেছেন। প্রতিবেশী বুড়ি যে তাঁর পথে প্রতিদিন কাঁটা বিছিয়ে রাখতো, অসুস্থ অবস্থায় মহানবী (সা) তার সেবা-যত করতে গেলে সে অনুতপ্ত হয়ে ইসলাম কবুল করে মহানবীর (সা) নিকট তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আরবের যে বুড়ি মহানবীর প্রচারিত দ্বীন প্রত্যাখ্যান করে মহানবীকে (সা) গালমন্দ করতে করতে ভারী বোঝা নিয়ে অতি কষ্টে মাক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, মহানবী (সা) বোঝা বহনে তার কষ্ট দেখে এগিয়ে এলেন এবং সেটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে তাকে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিলেন। যাওয়ার সময় বুড়ি যখন তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন যে, তিনি সেই ব্যক্তি, যার জন্য সে মক্কা ছেড়ে চলে এসেছে। তখন সে ডুকরে কেঁদে উঠলো এবং অনুতাপের অনলে দগ্ধ হয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলো ‘এই যদি সেই মুহাম্মদ হয়, তাহলে আমাকে মুহাম্মদের দেশে নিয়ে চলো।’ অতঃপর মহানবী (সা) পুনরায় সেই বুড়ির ভারী বোঝা নিজ কাঁধে বহন করে তাকে তার ঘরে পৌঁছে দিলেন।
এই হলো মহানবীর (সা) পরিচয়। তাঁর মহত্ত্ব, উদারতা, ন্যায়পরায়ণতা ও মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে হযরত উমরের মতো কঠিন দিলের মানুষও মুসলমান হয়ে শ্রেষ্ঠ মানবিক গুণের অধিকারী হয়েছেন। শত বাধা-বিপত্তি ও বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে অত্যল্পকালের মধ্যে ইসলামকে বিজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত করা এবং দুনিয়ার সকল অন্ধকার ও ভ্রান্ত মতবাদের ওপর আল্লাহর দ্বীনকে চূড়ান্তরূপে বিজয়ী করার জন্য যে দু’টি জিনিস সহায়ক ছিলো তার একটি মহাগ্রন্থ আল কুরআন এবং অন্যটি কুরআনের দীপ্ত আলোয় উদ্ভাসিত সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব নবী মুহাম্মদের (সা) জীবনাদর্শ।
আল কুরআন ও মহানবীর (সা) সে আদর্শ এখনো বিদ্যমান মানবজাতি তা গ্রহণ করে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসতে পারে। এ পথেই রয়েছে মানুষের মুক্তি, শান্তি ও সার্বিক কল্যাণ।