আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। বিশ্ববাসীকে সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও সফলতার পথ প্রদর্শনের জন্য সর্বশেষ নবী প্রেরণ করেছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং বান্দাদের নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যেন তাঁর আনুগত্য করে। তাঁর আদেশ-নিষেধ শিরোধার্য করে। তাঁর শিক্ষা-নির্দেশনা মেনে চলে। সর্বোপরি তাঁকে আদর্শরূপে ধারণ করে।
সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর নির্দেশমতো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করেছেন। এক্ষেত্রে গোটা উম্মতের ইতিহাসে তাঁদের রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। নবীজীর আনুগত্যের যে দৃষ্টান্ত তাঁরা স্থাপন করেছেন এর নজির কেবল তাঁরাই। তাঁরা তাঁর আদেশ-নিষেধ, শিক্ষা-নির্দেশনা, বাণী, কর্ম সবকিছুর অনুসরণ করতেন। তাঁর চোখের ইশারা ও মনের ভাষা পর্যন্ত অনুধাবন করতেন। তাঁর আদেশ-নিষেধ মানার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতেন। তাঁর আদেশকে সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিতেন। তাঁর পছন্দ নয় এমন কাজ পরিহার করতে বিন্দুমাত্রও দ্বিধা করতেন না। আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, লেনদেন, চলাফেরা, স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার সর্বক্ষেত্রে তাঁকে আদর্শরূপে ধারণ করেছিলেন। তাঁদের জীবন ছিল নববী-আদর্শের জীবন্ত ছবি। নবীজীর পরিপূর্ণ ও একনিষ্ঠ আনুগত্যই গোটা উম্মতের মধ্যে তাঁদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্মে পরিণত করে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের আনুগত্যের সব দিক, সব বৈশিষ্ট্য, সব দৃষ্টান্ত আলোচনা করা দুরূহ। এ তো অকূল সমুদ্র। এখানে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে কয়েকটিমাত্র ঘটনা উদ্ধৃত করব।
এক.
খায়বারের যুদ্ধের ঘটনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে যুদ্ধে ছিলেন। একজন এসে জানাল, মানুষ গাধার গোশত খাচ্ছে। তিনি একজনকে এই ঘোষণা করতে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমাদেরকে গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করেছেন। তোমরা তা খেয়ো না, ফেলে দাও। তা অপবিত্র।
এ ঘোষণা শুনে ডেগচিগুলো উপুড় করে দেওয়া হল অথচ তাতে গোশত টগবগ করছিল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪১৯৯, ৪২২১, ৫৫২৮
এখানে আমরা নবীজীর প্রতি সাহাবীদের আনুগত্যের দুটি বৈশিষ্ট্য দেখলাম :
ক. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গৃহপালিত গাধার গোশত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সাহাবীগণ যে মাত্র ঘোষণা শুনেছেন সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে নিবৃত্ত হয়ে গেছেন। অথচ গোশত রান্না হয়ে গিয়েছিল এবং তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন। তার পরও নবীজীর নির্দেশ মানতে কালবিলম্ব করেননি। এ চিন্তা করেননি যে, আচ্ছা! নিষেধাজ্ঞা যেহেতু মাত্র শুনেছি এবং তা শোনার আগেই আমরা রান্না করে ফেলেছি, তাছাড়া আমরা রণাঙ্গনে আছি, তাই আজকের মত খেয়ে নিই। সামনে থেকে আর খাব না।
খ. তাঁরা নবীজীর নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। গৃহপালিত গাধার গোশত খাওয়া থেকেও নিবৃত্ত হয়েছেন এবং ডেগচিও উপুড় করে দিয়েছেন।
দুই.
একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাবির রা.-কে বললেন, বাহরাইনের মাল এলে তোমাকে এত এত এত দেব। এ কথা বলে তিনি দুই হাত তিন বার প্রসারিত করেন। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত বাহরাইনের মাল আসেনি। আবু বকর রা.-এর খেলাফত আমলে আসে। তখন আবু বকর রা. ঘোষণা করলেন-
مَنْ كَانَ لَهُ عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِدَةٌ أَوْ دَيْنٌ، فَلْيَأْتِنَا.
যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন অথবা তাঁর কাছে কারো কোনো ঋণ থাকে তাহলে সে যেন আমার কাছে আসে।
ঘোষণা শুনে জাবির রা. গেলেন এবং নবীজীর ওয়াদার কথা জানালেন। আবু বকর রা. তাঁকে দুই হাত ভরে দিলেন। জাবির রা. গণনা করে দেখেন- পাঁচ শ।
এরপর আবু বকর রা. বললেন-
خُذْ مِثْلَيْهَا.
এর দ্বিগুণ নিয়ে যান। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২২৯৭
নবীজী যদিও জাবির রা.-কে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিশ্রুত মাল আসেনি। তাই তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয়নি। আবু বকর রা.-এর খেলাফত আমলে মাল এলে তিনি চিন্তা করেছেন, আজ নবীজী আমাদের মাঝে থাকলে নিশ্চয় নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতেন। কেননা নবীজী কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করেননি। এই চিন্তা থেকেই আবু বকর রা. ঘোষণা করেছেন। ঘোষণা শুনে যখন জাবির রা. এলেন তখন তিনি তাঁকে দান করলেন এবং নবীজী যেমন দুই হাত ভরে তিন বার দেওয়ার ওয়াদা করেছিলেন তিনিও সেভাবেই দিলেন।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিশ্রুতি পূরণের ব্যাপারে যখন সাহাবী এমন যত্নবান তো তাঁর আদেশ পালনের ব্যাপারে কত আন্তরিক হবেন তা সহজেই অনুমেয়।
তিন.
ফাতেমা রা. জাঁতা চালাতেন। এতে তাঁর কষ্ট হত। একবার কষ্টের কথা স্বামীর কাছে ব্যক্ত করলেন। এরপর নবীজীর কাছে কিছু যুদ্ধবন্দী এলে তিনি একজন খাদেমের আশায় তাঁর কাছে গেলেন। কিন্তু তাঁকে ঘরে না পেয়ে আয়েশা রা.-এর কাছে বলে আসেন।
নবীজী মেয়ের কথা জানতে পেরে তাঁদের ঘরে গেলেন এবং বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এমন জিনিস শিক্ষা দেব না, যা তোমাদের প্রার্থিত বস্তু থেকেও উত্তম? তা হল, তোমরা যখন ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাবে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদু লিল্লাহ্, ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়বে। এটা তোমাদের জন্য খাদেম থেকে উত্তম হবে।
আলী রা. বলেন-
فَمَا تَرَكْتُهَا بَعْدُ.
এরপর থেকে কখনো আমি এটা ছাড়িনি।
একজন জিজ্ঞাসা করল, সিফফীনের রাতেও কি ছাড়েননি?
বললেন-
وَلاَ لَيْلَةَ صِفِّينَ.
সিফফীনের রাতেও ছাড়িনি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭০৫, ৫৩৬২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭২৭,২৭২৮
সিফফীনের যুদ্ধ কত ভয়াবহ ছিল সবারই জানা। মুসলমানদের দুই পক্ষের মধ্যে এ যুদ্ধ হয়। এক পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন খোদ আলী রা., অপর পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন মুআবিয়া রা.। এ যুদ্ধে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়। এরকম যুদ্ধের রাতেও তিনি নবীজীর শেখানো তাসবীহ তরক করেননি। এ থেকে অনুমেয়, নবীজীর শিক্ষাকে তাঁরা কত গুরুত্ব দিতেন।
চার.
একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নে দেখেছেন, তিনি সাহাবীদের নিয়ে নিরাপদে বাইতুল্লাহ প্রবেশ করেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ‘হলক’ করেছেন। কেউ কেউ ‘কসর’ করেছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে উমরার উদ্দেশ্যে মক্কা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেন। সাহাবীগণ সাগ্রহে রওনা হলেন। কারণ ছয় বছর পর বাইতুল্লাহ যিয়ারতের সুযোগ এসেছে। নবীজী উট-বকরি সঙ্গে নিলেন এবং যুল হুলায়ফা নামক স্থানে গিয়ে উমরার ইহ্রাম বাঁধলেন।
মুসলমানদের খবর শুনে কুরাইশ ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়। মুসলমানদের বাধা দেওয়ার জন্য বাহিনী প্রেরণ করে। হুদায়বিয়া নামক স্থানে কুরাইশের একাধিক প্রতিনিধি নবীজীর কাছে আসে। তিনি তাদেরকে এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, আমরা উমরা পালনের জন্য এসেছি, যুদ্ধ করতে আসিনি। উমরা করে আমরা চলে যাব।
বিষয়টি আরো স্পষ্ট করার জন্য তিনি উসমান রা.-কে মক্কা প্রেরণ করেন। উসমান রা. কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে মুসলিমদের আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করেন।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে অবিচলতার সাথে যুদ্ধ করা, প্রয়োজনে জীবন দেওয়া- এ মর্মে তাঁর কাছে বাইআত হওয়ার আদেশ করেন। সাহাবীগণ তাঁর নির্দেশমতো বাইআত হন। (দ্র. তাফসীরে তাবারী ২১/৩১৬; সহীহ বুখারী, হাদীস ৪১৫১-৫২, ৪১৮৭, ২৭৩১, ২৯৬০; সীরাতে ইবনে হিশাম ৩/৩০৮-৩১৬)
এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, সাহাবীগণ নবীজীর আদেশকে সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিতেন এবং তাঁর নির্দেশ মানার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতেন। এখানে আমরা দেখেছি, যুদ্ধ করার জন্য সাহাবীদের মানসিক, সামরিক কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছিল না। তাঁরা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে আসেননি। তাছাড়া তাঁদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ বা ১৫ শ। যুদ্ধসামগ্রীও তেমন ছিল না। উপরন্তু তাঁরা নিজেদের আবাসভূমি থেকে অনেক দূরে ছিলেন। পক্ষান্তরে শত্রুপক্ষ ছিল আপন নগরীতে। এমন অসম পরিস্থিতিতেও তাঁরা নবীজীর হাতে হাত রেখে যুদ্ধের শপথ গ্রহণ করেন।
পাঁচ.
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. মক্কার সফরে ছিলেন। পথে এক বেদুঈনের সাথে দেখা হল। তিনি লোকটিকে আগে বেড়ে সালাম দিলেন। নিজের সওয়ারীর উপর তুলে নিলেন এবং পরিধানের পাগড়িটা হাদিয়া দিলেন।
আবদুল্লাহ ইবনে দিনার সাহাবীর এই আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, এরা বেদুঈন। সামান্য কিছু পেলেই খুশি হয়ে যায়।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বললেন-
إِنَّ أَبَا هَذَا كَانَ وُدًّا لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، وَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ أَبَرَّ الْبِرِّ صِلَةُ الْوَلَدِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ.
তার পিতা আমার পিতার বন্ধু ছিল। আর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, পিতার বন্ধুর সাথে সদাচার করা পুত্রের জন্য বড় সওয়াবের কাজ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৫২
মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচার অত্যন্ত জরুরি। নবীজী এ ব্যাপারে জোর তাকিদ করেছেন। পিতা-মাতার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সদাচারের শিক্ষাও তিনি দিয়েছেন। এ শিক্ষা সাহাবী কত গভীরভাবে হৃদয়ে ধারণ করেছেন তা আমরা দেখলাম। সফরে পিতার এক বেদুঈন বন্ধুর ছেলেকে পেয়ে নিজের সওয়ারীর উপর তুলে নিয়েছেন এবং পরিধানের পাগড়ি উপহার দিয়েছেন। অথচ তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবী ছিলেন।
ছয়.
একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবুল হায়ছাম রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি কোনো খাদেম আছে?
তিনি বললেন, জী না।
নবীজী বললেন, আমার কাছে যুদ্ধবন্দী এলে তুমি এসো।
এরপর নবীজীর কাছে দুইজন যুদ্ধবন্দী এল। আবুল হায়ছাম রা. নবীজীর কাছে গেলেন।
নবীজী বললেন, দুইজনের মধ্যে যাকে তোমার পছন্দ হয় নিয়ে নাও।
তিনি বললেন, হে আল্লাহর নবী, আপনি পছন্দ করে দিন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনের দিকে ইশারা করে বললেন, তাকে নিয়ে যাও, আমি তাকে নামায পড়তে দেখেছি আর তুমি তার সাথে সুন্দর ব্যবহার করো।
গোলাম নিয়ে আবুল হায়ছাম রা. বাড়ি গেলেন এবং স্ত্রীকে নবীজীর ওসিয়ত সম্পর্কে অবহিত করলেন।
স্ত্রী বললেন-
مَا أَنْتَ بِبَالِغٍ مَا قَالَ فِيهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلاَّ أَنْ تُعْتِقَهُ.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোলামের ব্যাপারে যে ওসিয়ত করেছেন তা পালন করার একমাত্র পথ হল তাকে আযাদ করে দেওয়া।
আবুল হায়ছাম রা. বললেন-
فَهُوَ عَتِيقٌ.
তাহলে সে আযাদ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৬৯
নবীজী আবুল হায়ছাম রা.-কে গোলামের সাথে সদাচারের ওসিয়ত করেছেন, আযাদ করতে বলেননি। কিন্তু তাঁর বুদ্ধিমতী স্ত্রী চিন্তা করেছেন, গোলাম আমাদের মালিকানায় থাকলে হয়তো আমরা তার সাথে যথাযথ সুন্দর আচরণ করতে পারব না। নবীজীর ওসিয়ত সুচারুরূপে পালন করার একমাত্র পথ হল তাকে আযাদ করে দেওয়া। এ কথা শুনে আবুল হায়ছাম রা. আর দেরি করলেন না, সঙ্গে সঙ্গে তাকে আযাদ করে দিলেন। সাহাবীদের বৈশিষ্ট্য এটাই- তাঁরা নবীজীর নির্দেশ অনুযায়ী উত্তমভাবে আমল করতেন।
সাত.
একবার আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বকরি যবেহ করলেন। এরপর পরিবারের লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন-
أَهْدَيْتُمْ لِجَارِي الْيَهُودِيِّ؟ فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَا زَالَ جِبْرِيلُ يُوصِينِي بِالْجَارِ، حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ.
তোমরা কি আমার ইহুদী প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিয়েছ? আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, জিবরীল প্রতিবেশী সম্পর্কে আমাকে এমন তাকিদ দিয়েছেন যে, আমার মনে হয়েছে, তাকে ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৫২
প্রতিবেশীর উপর নবীজী অনেক গুরুত্বারোপ করেছেন। তা সাহাবীর অন্তরে এমনভাবে বদ্ধমূল হয়েছে যে, নিজেদের জন্য যবেহকৃত বকরির গোশত ইহুদী প্রতিবেশীকে দেওয়া হয়েছে কি না তা পরিবারকে জিজ্ঞাসা করেছেন।
আট.
একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোনার আংটি বানালেন। তখন সাহাবীগণও সোনার আংটি বানালেন। পরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা খুলে ফেললেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম, আমি আর কখনো তা পরিধান করব না। তখন সাহাবীগণও খুলে ফেললেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭২৯৮
এখানে আমরা দেখলাম, নবীজীকে সোনার আংটি বানাতে দেখে সাহাবীগণও বানিয়েছেন। পরে যখন তিনি তা খুলে ফেলেছেন তখন তাঁরাও খুলে ফেলেছেন। অথচ নবীজী তাঁদেরকে খুলে ফেলার আদেশ করেননি। কিন্তু তিনি খুলে ফেলায় তাঁরা বুঝে গেছেন, তা আর পরিধান করা যাবে না। যে জিনিস নবীজী আর কখনো পরিধান না করার শপথ করেছেন, তাতে কোনো কল্যাণ নেই।
নয়.
নবীজীর একজন স্ত্রী হলেন উম্মে সালামা রা.। তাঁর আগের স্বামী ছিলেন আবু সালামা রা.। আবু সালামা রা.-এর ইন্তেকালের পর নবীজী তাঁকে বিয়ে করেন। তাঁর আগের স্বামীর ঔরসজাত একজন সন্তান হল উমর ইবনে আবু সালামা রা.। তাঁর প্রতিপালন করতেন নবীজী। একবার খাওয়ার সময় উমর ইবনে আবু সালামা রা. পাত্রের এখান থেকে ওখান থেকে খাচ্ছিলেন। নবীজী বললেন, হে বাছা! খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বলবে। ডান হাতে খাবে এবং নিজের দিক থেকে খাবে।
উমর ইবনে আবু সালামা রা. বলেন-
فَمَا زَالَتْ تِلْكَ طِعْمَتِي بَعْدُ.
এরপর থেকে আমি সর্বদা এভাবেই খেতাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৩৭৬
খাওয়ার কিছু আদব রয়েছে। একটি আদব হল, নিজ নিজ দিক থেকে খাওয়া। উমর ইবনে আবু সালামা রা. ছোট্ট বালক হওয়ায় এ আদবটি তাঁর জানা ছিল না। তিনি পাত্রের এখান থেকে ওখান থেকে খাচ্ছিলেন। নবীজী তাঁকে খাওয়ার আদব শিক্ষা দিলেন। আমরা লক্ষ করেছি, নবীজীর শেখানো আদব তিনি কত যতেœর সাথে পালন করেছেন।
দশ.
একদিন হাকীম ইবনে হিযাম রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিছু চাইলেন। নবীজী তাঁকে দিলেন। তিনি আবার চাইলেন। নবীজী আবার দিলেন। তৃতীয়বার চাইলেও নবীজী দিলেন এবং বললেন, হে হাকীম, এই সম্পদ হল সবুজ, সুস্বাদু। যে লালসা ছাড়া তা গ্রহণ করে তাতে বরকত দেওয়া হয়। যে লালসার সাথে নেয় তাতে বরকত দেওয়া হয় না। সে ওই ব্যক্তির মতো হয়, যে খায় কিন্তু তার ক্ষুধা মেটে না। আর উঁচু হাত নিচু হাত থেকে উত্তম।
নবীজীর যবানে এ কথা শুনে হাকীম রা. বললেন-
يَا رَسُولَ اللهِ! وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالحَقِّ، لاَ أَرْزَأُ أَحَدًا بَعْدَكَ شَيْئًا حَتَّى أُفَارِقَ الدُّنْيَا.
হে আল্লাহর রাসূল, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ, আমি আপনার পর যতদিন বেঁচে থাকব কারো কোনো সম্পদ কমাব না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৭২
এখানে নবীজী হাকীম ইবনে হিযাম রা.-কে মানুষের কাছে চাওয়ার জন্য সরাসরি নিষেধ করেননি। তিনি শুধু একটি নসীহত করেছেন। এ নসীহত সাহাবী এমন গভীরভাবে ধারণ করেছেন যে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করেছেন, মৃত্যু পর্যন্ত কারো কাছে কিছু চাইবেন না। সাহাবী তাঁর প্রতিজ্ঞা পূরণও করেছেন।
আবু বকর রা.-এর খেলাফত আমলে অনুদান গ্রহণের জন্য তাঁকে ডাকা হয়েছে কিন্তু তিনি নেননি। উমর রা.-এর যমানায়ও ডাকা হয়েছে; তখনো তিনি নেননি। উমর রা. একদিন স্পষ্ট বলেছেন, হে মুসলিমগণ, আপনারা সাক্ষী থাকবেন, আমি হাকীম ইবনে হিযামের কাছে ‘ফাই’ থেকে তার প্রাপ্য পেশ করেছি কিন্তু তিনি গ্রহণ করেননি। (দ্র. প্রাগুক্ত)